দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ: শ্রবণ, স্মৃতি আর সময়ের গল্প

মৌসুমী ভৌমিক

Please wait while flipbook is loading. For more related info, FAQs and issues please refer to DearFlip WordPress Flipbook Plugin Help documentation.



২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায়, একুশে টেলিভিশনের স্টুডিওতে ফরাসি পরিচালক স্তেফান জুরদাঁ (Stefane Jourdain) সঙ্গীত সংগ্রাহক ও পরিব্রাজক দেবেন ভট্টাচার্যকে (১৯২১-২০০১) নিয়ে তাঁর ফিল্ম, Music According to Deben Bhattacharya-র জন্য শুটিং করছিলেন। সেদিন ঐ টেলিভিশনে দেবেনবাবুর সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের শুটিং ছিল। সাক্ষাৎকার নেবেন অভিনেতা আলি জাকের; দেবেনবাবু এবং আলি জাকের—দুজনেরই প্রস্তুতি চলছিল সেই সময়। তখন একুশে টিভি’র কর্ণধার, সাইমন ড্রিং সেট-এ ঢুকে ওঁদের সঙ্গে একটু গল্প করে গেলেন। ‘আপনি জানেন তো এই মানুষটা যে একজন ওল্ড রোম্যান্টিক?’ আলি জাকেরের দিকে তাকিয়ে সাইমন বলছিলেন। ’৬১-তে আমি যখন একটা রোড ট্রিপ করেছিলাম ইওরোপ থেকে ভারতে–আমার বয়স তখন নেহাতই কম–ইরান, আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি; তখন আমি ভাবছিলাম, না জানি কী করছি! আমার মতন আর কেঊ করেনি! কিন্তু এই মানুষটা তো আমার অনেক আগে ঐ একই পথে একটা লজ্ঝরে গাড়িতে চেপে গান রেকর্ড করতে করতে ইউরোপ থেকে দেশে এসেছিলেন। ওঁরা ছিলেন প্রি-বীটনিক, প্রাক-হিপি; আমরা বীটনিক; we are a bunch of old hippies around this table!’ এই ফিল্মের আর একটি দৃশ্যে বাংলাদেশের ট্রেন-এ বসে দেবেনবাবুকে স্তেফান জুরদাঁ জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন বেরিয়েছিলেন পথে?’ দেবেন বলেন, ‘কী জানি? কিশোর বয়সে একটা ট্রেনে বিনা টিকিটে চেপেছিলাম, কয়েক ঘন্টা চলার পর টিকিট চেকার এসে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবে? বললাম, জানি না। নামিয়ে দিলেন। সেই থেকে কত জায়গায় যে কখনো টিকিট কেটে আর কখনো বিনা টিকিটে ঘুরে বেড়ালাম!’

দেবেন ভট্টাচার্য ১৯৪৯-এ ইওরোপে চলে যান। প্রথম কয়েক বছর লন্ডনে, সেখান থেকে সুইডেন হয়ে প্যারিসে; কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোথাওই ঠিক স্থায়ীভাবে বসবাস করেননি। চলা ওঁর রক্তে ছিল। সারা জীবন ধরে পূর্ব থেকে পশ্চিম, পশ্চিম থেকে পূবের দিকে যাওয়া—এ-ই করে গেছেন। ‘Music According to’ -র voice-over-এ জুরদাঁ বলেন, ‘যে সময় ফ্রান্সের অ্যাল্যঁ দানিয়েলু (Alain Danielou), সুইস এলা মাইয়ার (Ela Maillart), আমেরিকার অ্যালেন গিন্সবার্গ পূব থেকে আরো পূবে আসছেন আলোকপ্রাপ্ত হতে, সেই সময় দেবেন উল্টো পথে পূব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিচ্ছেন। যখন অ্যালান লোম্যাক্স আমেরিকার সাঊথে যাচ্ছেন [কালো মানুষদের] গান রেকর্ড করবেন বলে, যে সময় জ্যঁ রুশ (Jean Rouch) ওয়েস্ট আফ্রিকায় চলে যাচ্ছেন ক্যামেরা নিয়ে, তখন দেবেন ভট্টাচার্য হয়ে উঠছেন সেই প্রথম মানুষ যিনি আফগানিস্তানে, ইজরায়েলে, এমনকি ফ্রান্সের জিপসিদেরও গান রেকর্ড করছেন।

প্রত্যেক যাত্রার পিছনে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও, কিছু একটা থাকে নিশ্চয়। একটা টান, একটা তাগিদ, কিছু একটা? Some sort of a passion it is. Or, compulsion. তা না থাকলে, কিশোর দেবেন কেন হঠাৎ ট্রেনে চেপে বসেছিলেন সেদিন? কেনই বা লন্ডনে গিয়ে কোথাকার কোন পোস্ট অফিস, কোথায় সেলফ্রিজেস ডিপার্টমেন্ট স্টোর-এ মাল বওয়ার কাজ করতে করতে, বছর-দু’বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিবিসিতে গিয়ে বলেছিলেন যে আমি ভারতীয় সঙ্গীতের ওপর অনুষ্ঠান করতে চাই? সামান্য রোজগারের পয়সা জমিয়ে রেকর্ডার কিনে ১৯৫৪-তে কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে নবনী দাসের গান শোনার পর সিউড়িতে ওঁর বাড়িতে গিয়ে, গান রেকর্ড করেছিলেন কেন? আজ সেই রেকর্ডিং-এর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম, কারণ (আমার জানা মতে) নবনী দাসের গানের আর কোনো রেকর্ডিং কোথাও পাওয়া যায় না। আসলে, কোথাও একটা বীজ থাকে আর বীজেরও কোনো পূর্ব যাত্রা থাকে।

পূর্ব যাত্রা

১৯৯৮-এ বাংলাদেশী লেখিকা শাহীন আখতার আর আমার যৌথ সম্পাদনায় একটা বই রেবিয়েছিল কলকাতার ‘স্ত্রী’ আর ঢাকার UPL থেকে, নাম জানানা মহফিল: বাঙালি মুসলমান লেখিকাদের নির্বাচিত রচনা, ১৯০৪-৩৮। আমি সেই সময় ‘স্ত্রী’র ইন-হাউস এডিটর হিসেবে চাকরিও করতাম। একই সঙ্গে সেটা আমার এবং অন্যদের ‘নিজের লেখা গান’ নিয়ে মজে থাকার সময় ছিল। রোজ রোজ অনুষ্ঠান করতে হতো না; ঘরে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে—মনে হতো বেশ একটা কিছু চলছে—ক্যাম্পাসসুলভ, political engagement যেন। আমি বেশিটা শ্রোতা, মাঝেমাঝে শিল্পীও। সে একটা পর্ব ছিল আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্ত নগরজীবনে। কিন্তু জানানা মহফিল বেরোবার কয়েক মাসের মধ্যে আমি পারিবারিক প্রয়োজনে বিলেতে চলে যাই আর তারপর কিছুদিন সেখানে ‘স্ত্রী’র মন্দিরাদির চিঠি নিয়ে নানান পাবলিশিং হাউসে ঘুরঘুর করি; কাজটাজ কিছু পাই না। ওই পরবাসে মন্দিরাদির মতন যত্ন করে আমার যাবতীয় inadequacyকে ঢাকাচাপা দিয়ে আমার ভিতর থেকে কাজ বার করে আনার দায় কে-ই বা নেবে, আর কেনই বা? ঘরে বসে টুকটাক ইন্ডেক্স করা আর লং ডিস্টান্সে ‘স্ত্রী’র জন্য অল্পস্বল্প কাজ করা ছাড়া আমার বিশেষ কিছুই করার থাকতো না তখন। তখনকার মতন গান তো থেমে গেছেই। ফলে সেই যে hiatus, ছেদ-এর কাল, তখন আমার মন ধীরে ধীরে অন্য পথের সন্ধান শুরু করলো। বাঁচার অন্য কোনো উপায়।

এখন অবশ্য মনে হয়, এই অন্য পথ খোঁজাটা আসলে আমার অনেকদিন আগেই শুরু হয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬-এ জানানা মহফিল -এর কাজ করতে শাহীন আর আমি পুরনো ঢাকার পাটুয়াটুলিতে যেতাম। সেখানে সার বাঁধা ক্যাসেটের দোকান। সবই লোকাল কোম্পানি–সঙ্গীতা, সাউন্ডটেক, ডন, জনি, সামাদ। বেগম পত্রিকার অফিসে নূরজাহান বেগমের কাছ থেকে ওঁর বাবা, সওগাত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ নাসিরুদ্দীনের কথা, dynamic ফজিলতুন্নেসাদের কথা জানতে ভালোই লাগতো নিশ্চয়, কিন্তু সেটা একটু যেন আলগা একটা ভালো লাগা ছিল; এখন ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পারি । বরং অতর্কিতে ওই সঙ্গীতা-সামাদ থেকে কেনা টেপ, যত রাজ্যের বিচ্ছেদ গান, বিচার গান, সে-ই আমায় পাকে পাকে জড়াচ্ছিল তখন। এবং তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে, বিলেতের কর্মহীনতার ভিতরে মমতাজের গাওয়া ‘আমি যাই যাই বলিতেছি হাতে বেশি সময় নাই, তুমি সামনে দাঁড়াও একবার দেখে যাই’—গ্রামোফোন রেকর্ডের মতন চক্রাকারে আমার মগজে ঘুরে চলতে লাগলো, ঘুরতেই থাকলো।

সেই শোনাকেই হয়তো বীজ ভাবা যায়। কিংবা বীজ খোঁজা যায় তারেক-ক্যাথরিনের কাছে শোনা, ওদের মুক্তির কথা ডকুমেন্টারিতে গান-গাওয়া র‌্যাডিকাল মঞ্জিলার গল্পের ভিতরে, যে নাকি ওদের বাড়িতে এসে বলেছিল, ‘আসলে তো আমি শিল্পী, স্বামী একজন লাগে সাইনবোর্ডের মতন, এইখানে ওইখানে গিয়া গান গাওয়া না হলে মুস্কিল হয়।‘ (পরে আমাদের রেকর্ডিং-এর সময় মঞ্জিলা আমার কাছে দুঃখ করেছিল যে তার সংসার টিঁকছে না; তা, টিঁকবে কেনই বা?)। বা বীজ ছিল মানিকগঞ্জের মাতাল রাজ্জাকের ক্যাসেটের মোড়কে, যেখানে মাতাল লেখা ছিল ‘ত’ টাকে উল্টে দিয়ে, অর্থাৎ এইভাবে—মাΩ।ল। বীজ কলকাতার ফরাসি মেয়ে, অ্যানথ্রোপলজিস্ট অনু জালে’র মাস্টার্স্ ডিসার্টেশনের জন্য প্রতিমা বড়ুয়ার ঘরে করা রেকর্ডিং-এও ছিল, যেখানে তিনি ‘আরে ও মোর ভাবের দেওরা, থুইয়া আয় মোক বাপরে ভাইয়ার দ্যাশে রে’ গাইতে গাইতে, হঠাৎ ‘মেয়েটার জন্য মনে কষ্ট হয়’, বলে চুপ করে যান।
এইসব কোনোটাই শুধু গানের গল্প নয়, গান আর জীবনের ভিতরকার সম্পর্কের কথা। বিবিসির প্রতিষ্ঠাতা, ব্রডকাস্টার জন রীথের স্মরণে প্রতি বছর একটি বক্তৃতার আয়োজন হয়; ২০০৬ সালে সেই বক্তৃতা দিয়েছিলেন পিয়ানিস্ট/কন্ডাক্টর ড্যানিয়েল ব্যারেনবয়েম। পাঁচটি পর্বের সেই বক্তৃতামালার প্রথমটির শিরোনাম ছিল ‘In the Beginning there was Sound’, আদিতে ধ্বনি ছিল। তাতে ব্যারেনবয়েম বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, সঙ্গীতের বিষয়ে সত্যি করে, গভীরভাবে কিছু বলা আসলে সম্ভব নয়। আমরা কেবল আমাদের প্রতিক্রিয়ার কথাই বলতে পারি; all we can do then is speak about our own reaction to the music.’
এই reaction শিল্পীর– অর্থাৎ যে আমি সঙ্গীত সৃষ্টি করি, তার; এই reaction শ্রোতারও।

দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ

ইংরেজিতে song শব্দটা অনেক সময় গানের সুর বা কোনো মিউজিকাল কম্পোজশনের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। সং উইদাউট ওয়ার্ডস্, যেমন আমাদের ক্ল্যাসিকাল যন্ত্রশিল্পীরা বন্দিশ, ধুন বাজিয়ে থাকেন। আমার লেখার ক্ষেত্রে গান শব্দটাকে আমার সেইভাবে ব্যবহার করতে ইচ্ছে করে, আমি সঙ্গীত বলতে চেয়েও গান লিখতে চাই। এই লিবার্টিটুকু নিয়েই বলি: গান এবং জীবনের সম্পর্কের সূত্র খুঁজতে গিয়েই দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভের জন্ম। The Travelling Archive: Field recordings and field notes from Bengal. আজ দশ বছরের বেশি সময়ে ধরে সুকান্ত মজুমদার আর আমি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ আর সংলগ্ন নানান অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গান রেকর্ড করি। আমাদের নানান মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, সেই টানে আমরা অনেক জায়গায় ফিরে ফি্রে যাই। এইভাবে আমরা শুনতে শিখি, আমাদের শোনার গল্প অন্যদের শোনাতে চাই। শোনা বলতে শুধু গান শোনা না, যে শব্দ প্রকৃতি আর মানুষের নিত্যদিন এবং কালবাহী জীবন থেকে সুর হয়ে, কথা হয়ে, কত কত ধ্বনি হয়ে অথবা নৈঃশব্দ্যের রূপ ধরে উঠে আসে, আমাদের চলার পথে তাকেই আমরা শোনার চেষ্টা করি, বুঝতে চাই, আর যতটুকু পারি, আমাদের যন্ত্রে ধারণ করে রাখি। আমাদের সংগ্রহ দিয়ে আমরা ওয়েবসাইট সাজাই, তা নিয়ে লিখি, তা দিয়েও লিখি—যাকে আমরা শব্দে লেখা প্রবন্ধ বা audio essay নাম দিয়েছি। এখন সেই audio essay-এর সিডি ছাপিয়ে, আমাদের দু’জনের একটা কোম্পানি করে, একটা ছোট বই সমেত বিক্রিও করছি; কোম্পানির নাম দিযেছি Travelling Archive Records (www.travellingarchiverecords.com)। তার একটাই সিডি বেরিয়েছে এখনো পর্যন্ত, পরেরটার কাজ চলছে। এই কোম্পানির জন্য যাবতীয় কাজ আমরা নিজেরাই করি–পরিকল্পনা, রেকর্ডিং, লেখা, এডিট, ডিজাইন, বিজ্ঞাপন–মায়, ব্যাগে করে এখানে ওখানে সিডি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত। বন্ধুরা সাথ দেন অবশ্যই। জীবনের আরো নানা কিছুর পাশাপাশি আমাদের এই কাজ চলে–লেখা, পড়া, ঘর করা; সিনেমা থিয়েটরের জন্য সুকান্তর রেকর্ডিং, সাঊন্ড ডিজাইন; আমার গান—সবকিছুই জড়িয়ে জারিয়ে থাকে।

শুরুতে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না, শুধু বীজটাই ছিল। আমার ছিল একরকম, সুকান্তর আর একরকম। তা দিয়েই ফিল্ড রেকর্ডিং শুরু হয়েছিল। সেটা ২০০৩-এ। তারপর, এক সুর থেকে অন্য সুরে, গান থেকে গানে, স্থান থেকে স্থানে, এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে যাওয়া—দেখি যে একটু একটু করে একটা নক্সা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, মখমলবফের ‘গাব্বেহ’ বা কার্পেট যেমন; তার ভিতরে আমাদের নিজেদের গল্পও বোনা হয়ে চলেছে। আমি এই লেখা লিখছি আজ জুনের ২০১৪-এর শেষ সপ্তাহে; ঠিক দু’ সপ্তাহ আগে আমদের ওয়েবসাইট, www.thetravellingarchive.org আমরা নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে আপলোড করেছি। তাতে এই নক্সাটা খানিক ধরা আছে। আমাদের ভাবনা আর পথ এই দশ বছরে কত কত দিকে যে যেতে চেয়েছে, তার একটা ছবি পাওয়া যায় ওর ভিতরে। ব্যারেনবয়েমের ভাষা ধার করে বলি, এ হলো আমাদের ‘inexpressible content of life’ আর ‘inexpressible content of music’ এর ভিতরকার ‘connection’ খোঁজা।
এবং এখন আমরা নিজেরাও নক্সাটা অনেকটা ধরতে পারছি। দেখতে পাচ্ছি যে, আসলে বোধহয় একটা প্রশ্নই এই কাজ থেকে উঠে আসছে। আর তা হলো, ইতিহাসকে কীভাবে শুনবো আমরা? How do we listen to history? শব্দ থেকে কীভাবে একটা সময়কে জানা যায়? কীভাবে শব্দ দিয়ে একটা সময়কে নির্মাণ করা যায়? শুরু থেকে অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের tagline ছিল A journey through the folk music of Bengal । সেই tagline-এর ‘folk’ শব্দটা আমায় বিব্রত করতো, কারণ আমরা শুধু তথাকথিত ‘folk’ নিয়ে কাজ করি কি না, এমনকি শুধু মিউজিক নিয়েও না। শব্দ নৈঃশব্দ্য, musical, non-musical sounds–অনেক কিছু এসে পড়ে এই কাজে। ফলে, আমাদের কাজকে এইভাবে আখ্যায়িত করে আমাদের সম্পর্কে কিছু পূর্বধারণা তৈরি করতে সাহায্য করছি কি না, সেটা আমাদের ভাবাতো। ভাবতাম, হয়তো The Travelling Archive: Field recordings from Bengal অনেক বেশি উপযুক্ত হবে। সেই ভাবনা থেকেই Field recordings and field notes from Bengal উঠে এসেছে।

নতুন করে করা ওয়েবসাইটের কথা চেনা অচেনা মানুষকে জানিয়েছি, খুব যে সাড়া পড়ে গেছে, এমন একেবারেই না। বরং সর্বৈব একধরনের প্রতিক্রিয়ার অভাব, যা প্রায় নিষ্ক্রিয়তারই সামিল। তেমনই অবশ্য হবার কথা। তবু, তার মধ্যেই মূলত দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে আমাদের কাছে। এক তো নিজেদের বন্ধুবান্ধব, ‘কমিউনিটি’র ভিতরকার আবেগ; সেটা খুবই জরুরি—এই কাছের লোকেদের কাছে থাকা। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ বুঝি বিপন্ন বা endangered গান, সুর, শব্দকে সংরক্ষণ করার কোনো একটি পরিকল্পিত প্রোগ্রাম। সেই দিক থেকে অনেকে খুশি হন, বলেন তোমরা খুব মূল্যবাণ কাজ করছো। মুশকিল হলো, এই প্রতিক্রিয়া আমাদের একটু অস্বস্তিতে ফেলে। তখন বলে বোঝাতে পারি না যে ব্যাপারটা আসলে ঠিক তেমন না। যদি কোনো ‘বিপন্ন’ শব্দ আমাদের কাজের ভিতরে এসে পড়ে, তা সে এসে পড়ে স্বাভাবিক নিয়মেই, পথ চলতে যেমন নতুন পুরনো, নানান মানুষের সাথে মানুষের দেখা হয়ে যায়। বিপন্ন বলে আমরা তাকে অনুসরণ করতে যাইনি, কোনো একটা সূত্র ছিল, কিংবা টান; বা ব্যাপারটা নেহাতই accidental.

লন্ডনে SOAS-এ পড়ান এক সাউথ আফ্রিকান এথনোমিউজিকোলজিস্ট, অ্যাঞ্জেলা ইম্পি, তাঁর মূল গবেষণা ছিল মোজাম্বিক, সোয়াজিল্যান্ড এবং সাউথ আফ্রিকার বর্ডার এলাকায় জু’স হার্প (Jew’s Harp, যাকে আমাদের এখানে পশ্চিম ভারতে মোরচাং বলে) আর মাউথ বো বলে দু’টি যন্ত্রের অবলুপ্তি নিয়ে এবং অ্যাডভোকেসি এথনোমিউজিকোলজি বলে একটা পদ্ধতির প্রয়োগ করে যন্ত্রগুলিকে কীভাবে জনজীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে তিনি ভাবছিলেন। অর্থাৎ, এ হলো সঙ্গীতের সাহায্যে একধরনের সচেতনতা এবং অধিকার বোধ জাগিয়ে তোলার কাজ। যে মেয়েরা এই যন্ত্র বাজাতেন, যাঁরা এই গান জানতেন, তাঁদের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে যন্ত্র বাজাতে শিখছেন অ্যাঞ্জেলা এবং এই যন্ত্রের সঙ্গে যে গল্প, আখ্যান জড়িত, তা জানছেন। মেয়েরা হয়তো একসঙ্গে গান বাজনা করতে করতে হাঁটছেন, একটা পুরনো অব্যবহৃত পথ ধরে হাঁটছেন, হঠাৎ কোনো গাছ দেখে একজন দাঁড়িয়ে পড়ে তার বাকল থেকে কী ওষুধ পাওয়া যেতো, সেই কথাটা বললেন, তার সঙ্গে কোনো গান তাঁর মনে এলো । এই করতে করতে, অ্যাঞ্জেলা লিখছেন, যন্ত্রগুলি নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে, সমাজে এই সুর শোনার আগ্রহ বাড়ছে, এবং তাতে শিল্পীদের কর্মসংস্থানও হচ্ছে।
অথবা ধরা যাক বাংলানাটকডটকম। ওঁরা অনেক প্রান্তিক শিল্পী এবং শিল্পের পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব নিয়েছেন। EZCC-ও এই ধরনের কাজই করেন। গানের দল ‘ভ্রমরা’ আক্ষরিক অর্থে এই গানের চর্চা করে গানের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। সেও কাজ করার একটা ধরন। এই সব কিছুর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের এই কাজ করা কেন, কোন উদ্দেশ্যে, এর ফলে কী লাভ হবে, কার লাভ হবে, তা স্পষ্ট করে নিজেরাই অনেক সময় বলতে পারি না। ফরাসি অ্যানার্কিস্ট কবি-শিল্পী, লিও ফেরে’র একটা বিখ্যাত গান ছিল Avec le temps, va, tout s’en va. . . সময় চলে যায়, সব চলে যায়, যাবেই . . . । আমাদের বিতর্কিত কবি আল মাহমুদেরও এইরকম একটা লাইন ছিল: ‘কিছুই থাকে না দেখো, পত্র পুষ্প গ্রামের বৃদ্ধরা/নদীর নাচের ভঙ্গী, পিতলের ঘড়া আর হঁকোর আগুন/উঠতি মেয়ের ঝাঁক একে একে কমে আসে ইলিশের মৌসুমের মতো. . .’ তাহলে কেন আমাদের এই কাজ করা?

কিছুই থাকে না জেনেও

২৯ এপ্রিল ২০০৬, অম্বিকাপুর, ফরিদপুর, বাংলাদেশ। হাজেরা বিবি’র কাছে আমরা যখন যাই, তখন তিনি আসলেই জীবনের যাবতীয় বিপন্নতা পার করে এসেছেন। এবার অপেক্ষার পালা। আমরা জানতাম ওঁর কথা। ফরিদপুরে যে চায়ের দোকানে সন্ধ্যেবেলায় আমাদের আড্ডা বসে, সেখানে এইসব গল্প চালু আছে । ‘ঊনার খাতা নিয়া গেছে, ফরহাদ মাজহারের লোক নিছে; না না প্রশিকা. . . এখন তো দেখার কেঊ নাই. . . এক সময় কী দাপটই না ছিল! জসীম উদ্দীন তো উনাকে মেয়ের মতো পালছিল, পাকিস্তান আমলে . . .’। গল্পের মোড় ঘোরে: ‘আচ্ছা, জসীম উদ্দীনের আসমানিরে যে কয় পাওয়া গেছে, সেটা কি সত্য?’
দেশ যখন pre এবং post-একাত্তর নিয়ে উত্তাল, তখন পালা গানের আসর কাঁপাতেন হাজেরা বিবি। গানের লড়াইয়ে তাবড় তাবড় পুরুষ শিল্পীকে ধরাশায়ী করবার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। বিশেষ করে একজন মহিলা শিল্পী, সেই সময়, গান গাইছেন, লিখছেন, হাজার হাজার মানুষ সেই গান শুনছে . . . চায়ের দোকানের আড্ডায় একজন এই আখ্যান শুরু করলে অন্যরা ধুয়ো দেন। গল্পের সত্যমিথ্যা কেঊ বিচার করার চেষ্টা করে না; মিথ্-এর আবার মিথ্যা কি?

এইসব গল্প শুনেই আমরা হাজেরা বিবির কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের যাবার পিছনে সচেতনভাবে বিপন্নতাকে প্রতিরোধ করার কোনো লক্ষ ছিল না। আমরা গিয়ে রেকর্ড করলে অঁর গান বেশিদিন বেঁচে থাকবে, এমন কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণও আমরা দেখিনি। কেবল সেদিন, সেই এপ্রিল-শেষের সন্ধ্যায়, মগ্রিবের আজানের সামান্য আগে, সেই মিথিকাল হাজেরা বিবির উঠোনে বসে আমরা দিন-অবসানের একটা আচ্ছন্ন করা সুর শুনেছিলাম। ‘এখন তো এক্কেরে বৃদ্ধ আমি. . . আগেকার মতো সুর হয় না।‘ সেই আর-না-হওয়া সুর সেদিন আমাদের যন্ত্রে ধারণ করা হয়েছিল। কী এমন হলো সেই রেকর্ডিং-এর ফলে? আর্কাইভে রেখে দিলাম, ওয়াবসাইটে তুলে দিলাম। তারপর? আসলে তো একটা মুহূর্ত এলো এবং চলেও গেল। তার একটা রেকর্ড রয়ে গেল, এই পর্যন্তই। সেদিন আমরা যদি না যেতাম হাজেরা বিবির কাছে, তাহলেই বা কী হতো? আমাদের যাবার সাত মাস পর, ডিসেম্বরের শীতে, এক শিষ্যের বাড়িতে গিয়ে ৯৩ বছর বয়সে হাজেরা বিবির মৃত্যু হলো। আমরা যাই বা না যাই, এমনটাই হতো। আমরা না গেলেও এপ্রিলের সেই সন্ধ্যায় মগ্রিবের আজানের সুর হাজেরার উঠোনে এসে পৌঁছতো আর সেই সুরকে interrupt করতো টিউকলের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। আমরা না গেলেও হাজেরার প্রপৌত্রী ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদতো সেদিন সন্ধ্যায়, আর হাজেরা বিবি বলতেন: তোমরা খাইয়া লও। আমরা না গেলে শুধু যা থাকতো না সেই সন্ধ্যার শব্দপটে, তা এক বহু-দেখা মানুষের শেষ বেলাকার উপলব্ধি, কিছুটা নির্দয় সময়ের প্রতি খেদ, খানিক পাওয়া না-পাওয়ার গল্প, ভুলে যেতে যেতে মনে পড়া গানের কলি, past glory-র স্মৃতিচারণ।

তুমি অন্তরেরই অন্তর্যামী, তোমায় আমি বলবো কি?
যে হালে রেখেছ মুর্শিদ, সেই হালে থাকি।

তবে আমরা এ-ও মানি যে মিলিয়ে যাবার আগে ধরে রাখা, সেদিনের ঐ শব্দপটের মূল্য আসলে অসীম। যেমন, দেবেন ভট্টাচার্য নবনী দাসকে রেকর্ড করেছিলেন। এই রেকর্ডিং দিয়ে কোনো কিছুকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কি না, কোনো ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখা যায় কি না, তার উত্তর আমাদের জানা নেই। অনেকে সেই কথা ভেবেই রেকর্ড করেন, যে, এই রেকর্ডিং শিল্পী বা সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠিকে তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। গুড়গাঁও-এর আর্কাইভস্ এন্ড রিসার্চ সেন্টার ফর এথনোমিউজিকলজির ডিরেক্টর শুভা চৌধুরী বলেন, আমরা অনেক বছর আগে রাজস্থানের শিল্পীদের গান রেকর্ড করেছি; এখন ওঁদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের আর্কাইভস্-এ পুরনো রেকর্ডিং শুনে গান শেখেন, আমরা তাঁদের বলি যে এই এই গানগুলো ছিল। অর্থাৎ, একটা renewal of repertoire। এই কথাও বলা হয় যে দেবেনবাবু নবনী দাসের সেদিনের রেকর্ডিং করেছিলেন বলে তার বছর দশেক পর আমেরিকার কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ নবনী দাসের কাছে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ গিন্সবার্গ জানতেন ফ্রান্স-এ পাঁচের দশকে BAM কোম্পানি থেকে বেরোনো দেবেন ভট্টাচার্যের Chants et Danses Populairies du Bengale অ্যালবামের কথা। (অবশ্য এমনও হতে পারে যে যেহেতু গিন্সবার্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হয়েছিল এবং যেহেতু ওঁরা নবনী দাসের কাছে যেতেন, তাই গিন্সবার্গও গিয়েছিলেন )। সে যা-ই হোক, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে গিন্সবার্গ সিউড়িতে গিয়েছিলেন বলেই ১৯৬৭-তে অ্যালবার্ট আর স্যালি গ্রসমান পূর্ণদাস আর লক্ষ্মণ দাসকে আমেরিকায় নিয়ে যান। বাকিটা তো ইতিহাস। অর্থাৎ, সেই ১৯৫৪-এর রেকর্ডিং থেকে শুরু করে দেবেন ভট্টাচার্য, অ্যালেন গিন্সবার্গ, নবনী দাস, পূর্ণদাস, গ্রসমান দম্পতি, প্রি-বীট, পোস্ট-বীট—সব একটা সূত্রে গাঁথা হয়ে গেলেন।

আমাদের হাজেরা বিবির রেকর্ডিং থেকে তেমন কোনো সূত্র তৈরি হবে কি না, বলা মুস্কিল। ১৯৫৪ আর আজকের পৃথিবীর মধ্যে তফাত অনেক। একবার আমরা শীতকালে বারুইপুরে পাখি আসে শুনে সেখানে গিয়েছিলাম। পাখির কথা কেউ আর বলতে পারে না। তারপর একজন বলেছিল, পাখি আসতো, আর আসে না। ঘরে ঘরে নল (সে ঠিক এইভাবেই বলেছিল; বন্দুকের নল বুঝিয়েছিল মনে হয়)। লিখতে বসে এখন আমার সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। ঘরে ঘরে রেকর্ডিং যন্ত্র, বাউলরা এক একজন পোড়খাওয়া বিদেশমন্ত্রক, মমতাজ পালা গান না গেয়ে ‘পোলা তো নয় একখান আগুনেরই গোলা’ গাইলে অনেক বেশি অনুষ্ঠান পান, অনেক বেশি রোজগার করেন, সেই গান ফোনে ফোনে ‘দেখা’ যায়। এখন আমার আপনার সবার কাছেই সেই গান থাকতে পারে। রেকর্ডিং-এর নভেল্টি ব্যাপারটা আসলে চলে গেছে। ১৯৫৪-এ নবনী দাস নাকি গাবগুবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেবেনবাবুকে বলেছিলেন, তুমিও তো দেখছি আমার মতনই বাউল। কেবল তোমার যন্ত্রটির জগদ্দল পাথরের মতন ওজন। আর ২০১৩-তে সিলেটের সুনামগঞ্জের হরিপুর গ্রামে আমাদের রেকর্ডিং শেষ হবার পর আমাকে একটা গান শোনাতে বলেছিল; আমি সেখানে কী গাইবো? সব জায়গায় সব গান গাওয়া যায় না, সবার গাওয়া ঠিকও না। তবু সৌজন্য রক্ষা করতে, অনেক ভেবে, মমতাজের ক্যাসেট থেকে বহুকাল আগে শেখা একটা বিচ্ছেদ গান গাইলাম—‘বন্ধু বিনে এ প্রাণ যায় না রাখা।‘ আমার গান শেষ হতে না হতেই কারো একটা মোবাইলে মমতাজের রেকর্ডটা বেজে উঠলো। সবাই খুব হাসলো তখন। নতুন আর কী দেবে এই সময়ে, বা এই সময়কে?
এ সবই আমাদের জানা। তারপরেও বলি, এই সব-জানা সময়েও আমাদের হয়তো কিছু জিনিস জানা বা শোনা হয় না। শ্রবণের সূক্ষ্মতা আসলে আয়ত্ব করতে হয়। এবং সেখানেই মনে হয় আমাদের রেকর্ডিং-এর কোনো বিশেষ ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে। একেই হয়তো ইতিহাসের শব্দ শোনা বলা যায়। সেদিন সন্ধ্যায় হাজেরা বিবির উঠোনের শব্দ-নৈঃশব্দ্যের ভিতরেই হিন্দু বিধবা যুবতী ননীবালা হাজেরা বিবি হয়েছিলেন; কবি জসীম উদ্দীনের ছায়ায় ছায়ায় তাঁর গান ডালপালা ছড়িয়েছিল, পাকিস্তানি আর্মি এসে তাঁর ঘর তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিল, তাঁর গানের খাতা উধাও হয়েছিল; মতিঝিলের তিনতলায় ডন কোম্পানি তাঁর ক্যাসেট বার করেছিল, সেই ক্যাসেট নেই যদিও তাঁর কাছে। তারপর পড়ন্ত বেলায় ফরহাদ মজহাররা নিয়ে গিয়ে তাঁকে যত্ন করে রাখলেন তাঁদের ঢাকায় ইউবিনিগের (UBINIG) অফিসে, ভক্ত হলেন। ওঁরাও নাকি হাজেরাকে রেকর্ড করেছিলেন।
‘কত মানুষ গান শুনতো, আমার আর হালিম বয়াতির পালা।‘ একবার সাধক-কবি বিজয় সরকার হাজেরার গান শুনে বললেন: মা রে, গান তো আমি বাঁধছি, এত সুন্দর সুর দিয়া তো আমি গাইতে পারি না।
তার জন্য আমারে একশ টাকা দিল।

কোন গানটা ছিল, মাসি?
গানটা ছিল . . . গান অনেকদিন না গাইলে ভুল হইয়া যায় না?
মনে পড়বে নিশ্চয় বিজয় সরকারকে কোন গান শুনিয়েছিলেন।
[হাজেরা চুপ করে থাকেন। রেকর্ডিং-এ ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে পাই।]
কোন গানটা যানি গাইছিলাম? সেই গানটা তো মনে পড়তেছে না।
সালামতভাই বলেন, তুমি কি পোষাপাখির গান গাইছিলা?
না।
তুমি কি সুন্দর পৃথিবী ছেইড়ে—এইটা বলছিলা? না কি তুমি এমন মাধবী রাতে . . .
না না . . . কোন গান? গানটা মনে পড়তেছে না।
[আবার সবাই চুপ হয়ে থাকে। হঠাৎ খুব মৃদু স্বরে হাজেরা গাইতে শুরু করেন—]

তারে পাবি কোন সাধনে রে
মন মানুষ ধরো যতনে।

বাড়ির কাছে আরশিনগর, পড়শি একোজন
একদিনও না দেখলি রে সেই মানুষটারই মন।

[এবার গানটা আস্তে আস্তে শরীর পেতে থাকে, হাজেরার ইতস্ততভাবটা কেটে যায়।]

সে যে সকল অভাব করে পূরণ রে
ও তুই সাবধানে আর গোপনে,
মন মানুষ ধরো যতনে।

বিলাস বিছনায় শুইয়া মণি তুই
নিশি করলি ভোর
শিয়রে বসিয়া ডাকে রে তোর
দরদী একজন।
সে যে হাত বাড়ায়ে ডাকে তোরে রে
তারে চিনলি না তুই জীবনে
মন মানুষ ধরো যতনে।

বিজয় বলে, বেলা গেলো খেলা ভেঙে যায়
যা ছিল তোর পুঁজিপাট্টা লুটে নিল ছয় চোরায়
এখন যা আছে তাই সঁপে দিয়া রে
আরে ক্ষমা চাও গা বন্ধুর চরণে
মানুষ ধরো যতনে।

এই তো! কী সুন্দর মনে পড়ে গেল পুরোটা? কী আশ্চর্য!
কই? গলা নাই। সুর হয় না।
তোমার বয়স কত হইছে গো মাসি?

৯৩।

তারাদের কথা

গল্পটা Little Prince নামের সেই আশ্চর্য বইটাতে আছে। আমরা অনেকেই অনেকবার পড়েছি। বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে International Association of Sound and Audiovisual Archives (IASA)-এর কনফারেন্সের আমন্ত্রিত প্রধান বক্তা , আইনজীবি এবং লিগাল অ্যাক্টিভিস্ট, লরেন্স লিয়্যাং, সেই গল্পটাই আবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। লরেন্স ব্যাঙ্গালোর-এর অল্টারনেটিভ ল ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ওঁর চর্চা মূলত ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটের রাজনীতি নিয়ে, লরেন্স যতদূর সম্ভব open source এবং piracy –র পক্ষে, অর্থাৎ সবার সঙ্গে জ্ঞান ভাগ করে নেবার পক্ষে সওয়াল করেন। লরেন্স বলছিলেন, ‘Little Prince -এর সেই ব্যবসায়ীকে মনে আছে?’
তো, ছোট্ট রাজপুত্র তো নানান গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নানা বিচিত্র মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। একটা গ্রহে এসে দেখে একজন খুব ব্যস্ত ব্যবসায়ী, তার চোখ তুলে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই। সে কেবল গুনে চলেছে—‘. . . five hundred and one million, six hundred and twenty-two thousand, seven hundred and thirty one. . .’ কিসের পাঁচশ এক মিলিয়ন? লিটল্ প্রিন্স জানতে চায়। বার বার জিজ্ঞেস করে। লোকটা বোঝে উত্তর না দিয়ে তার উপায় নেই।
সে বলে, আকাশে থাকে, ছোট ছোট জিনিস।
পোকা?
না না, মাঝে মাঝে চকচক করে।
মৌমাছি?
আরে না! ছোট্ট ছোট্ট, সোনালি। ওদের দিকে তাকিয়ে বেকার মানুষেরা অনেক সময় দিনের বেলায় স্বপ্ন দেখে। আমার অবশ্য একটুও বসে বসে স্বপ্ন দেখার সময় নেই। কারণ আমি খুবই সিরিয়াস একজন মানুষ।
ও! তুমি তারার কথা বলছ?
হ্যাঁ, তাই। তারাদের কথাই বলছি।
পাঁচশ মিলিয়ন তারা দিয়ে তুমি কী করো?
Five hundred and one million, six hundred and twenty-two thousand seven hundred and thirty-one, আমার হিসেবে ভুল হয় না।
আর সেই পাঁচশ মিলিয়ন তারা দিয়ে তুমি কী করো?
Five hundred and one million, six hundred and twenty-two thousand seven hundred and thirty-one.
তুমি তাদের দিয়ে কী করো?
আমি তাদের দিয়ে কী করি?
হ্যাঁ।
কিছু না। ওরা আমার।
তারারা তোমার?
হ্যাঁ।
আমি একজন রাজাকে দেখেছি যার. . .
রাজাদের নিজের বলে কিছু হয় না, ওরা কেবল রাজত্ব করে। ব্যাপারটা আলাদা।
তারারা তোমার হলে তোমার কী লাভ?
আমি ধনী হই।
আর ধনী হয়ে কী লাভ?
যদি কেউ নতুন তারার সন্ধান দেয়, তাহলে আমি আরো তারা কিনতে পারি।
এই তর্ক আরো খানিক্ষণ চলে। তারা কী করে তোমার হয়? তাহলে তারারা কার, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারপর লিটল্ প্রিন্স বলে, আমার যদি একটা সিল্কের স্কার্ফ থাকত তাহলে আমি সেটা গলায় জড়াতাম, যদি আমার একটা ফুল থাকত, আমি সেটা তুলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। তারাকে তো সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া যায় না।
ব্যস্ত ব্যবসায়ী বলল যে সে তারাদের ব্যাংকে রেখে দেয়।
কী ভাবে?
কতগুলো তারা হলো ওর, সেই সংখ্যাটা একটা কাগজে লিখে ড্রয়ারে রেখে দেয়।
লিটল্ প্রিন্স ভাবল, ব্যাপারটা বেশ কাব্যিক, কিন্তু একটু অদ্ভুত।
সে বলল, আমার একটা ফুল আছে, তাকে আমি রোজ জল দিই। আমার তিনটে আগ্নেয়গিরি আছে, সেগুলি আমি রোজ পরিষ্কার করি; যেটা ঘুমন্ত, সেটাকেও পরিষ্কার করি, কারণ কবে কী হয়ে যায়, কেঊ তো জানে না। আমি যে ওদের যত্ন নিই, তাতে ওদের ভালই হয়। কিন্তু তুমি তো তোমার তারাদের কোনো কাজেই লাগো না।
(Antoine de Saint-Exupery-র The Little Prince, Chapter 13 থেকে। অনুবাদ আমার)

দিল্লির সেই কনফারেন্সে কপিরাইট, আর্কাইভ ইত্যাদি প্রসঙ্গে লরেন্স বলছিলেন যে, যে আর্কাইভ আমি তৈরি করলাম, যা আমি সংগ্রহ করলাম, তা দিয়ে কী করব আমি? আমিও তার কোনো কাজে লাগব তো? যা আমি নিজের বলে ভাবলাম, তাকে দেখে রাখা আমার দায়িত্ব নয় কি?

সব তারা তো চোখে দেখা যায় না। কিন্তু যদি মনে করি যে সেদিন সন্ধ্যায় হাজেরা বিবির স্মৃতি আর বিস্মরণের বিচরণভূমি থেকে যে শব্দ উঠে এসেছিল, সেই শব্দ ‘’আমাদের’, তাহলে তাকে দেখে রাখাও আমাদেরই কাজ। দ্য ট্র্যাভেলিং আর্কাইভে আমাদের সম্বল শব্দ-নৈঃশব্দ্য, গল্প, সুর, ছবি—সেই সব অনেকের সাথে ভাগ করে নিতেই যদি না পারলাম, তার গোড়ায় জলই যদি দিতে না পারলাম, তাহলে কী লাভ ড্রয়ারে তারার সংখ্যা লিখে রেখে?

কলকাতা, জুন ২০১৪।

___________________________

১। এই সাক্ষাৎকারটি The Travelling Archive-এর ওয়েবসাইটে দেখা যায় এই লিংকে গেলে পরে: https://www.thetravellingarchive.org/tribute/deben-bhattacharya/
২। আফগানিস্তানে এর আগে রেকর্ডিং হয়নি, এমন হয়তো না; অন্তত ওই একই সময়ে অন্যরাও সেখানে ফিল্ড রেকর্ডিং করছিলেন, হয়তো এক বছর আগে পিছে, যেমন লরা বুল্টন (১৮৯৯-১৯৮০, The Music Hunter বই-এর লেখক)। কিন্তু দেবেন ভট্টাচার্যর ১৯৫৫ সালের রেকর্ডিং দিয়ে ১৯৭২-এ লন্ডনের Argo কোম্পানি যখন Music from Afghanistan LP বার করে, তখন এরকম সঙ্গীত আর্কাইভ বা মিউজিয়ামের বাইরে সামান্যই শুনতে পাওয়া যেতো।
৩। Impey, Angela, ‘Sound, Memory and Dis/Placement: Exploring Sound, Song and Performance as Oral History in the South African Borderlands’, in Oral History, Spring 2008, pp. 44-55
৪। হাজেরা বিবির এই গানটি আমাদের ওয়েবসাইটে এই লিংক থেকে শুনতে পাওয়া যাবে https://www.thetravellingarchive.org/record-session/ambikapur-faridpur-bangladesh-29-april-2006-hajera-bibi/
৫। Baker, Deborah, A Blue Hand: The Beats in India. New Delhi: Penguin Viking, 2008, p.175.
৬। UBINIG, উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা—বাংলাদেরশের কবি লেখক তাত্ত্বিক ফরহাদ মাজহার এবং অ্যাকটিভিস্ট ও তাত্ত্বিক ফরিদা আখতার-পরিচালিত একটি NGO।