Faridpur, Bangladesh. 18 January 2013. Ibrahim Boyati

Listen to a song from this session
Artist:
Ibrahim Boyati
Composer:
Ibrahim Boyati
Form:
Bichchhed
Song region:
Faridpur







I have known Ibrahim Boyati for almost two decades; from the time of the shooting of Tareque Masud’s ‘Muktir Kotha’ in 1998. I was at the rehearsals with him and Muhammad Shah Bangali, a singer and composer from Chittagong, whom the ethnomusicologist Deben Bhattacharya had recorded in 1971.

As I write these lines, I think of the layers of sonic history contained in them. If an archive is the future of the past, as Alexander Stille calls it, then the present, the moment of the creation of sound, which is also the moment of its death, foretells the future. Who would have known that when a man from Paris had recorded refugee songs in an emerging Bangladesh in 1971, those sounds would find new meaning in a film made more than 25 years later? Who would also know that the young, blind and ever-smiling dotara player accompanying the singer on the sets of Muktir Kotha, our Ibrahim Boyati, would tell us his story of ageing with music; rather, of never ageing, in the two decades to come?

Late in the evening on 17 January 2013, we went to meet Ibrahim Boyati in the mazar of Khoka Pir in Faridpur town, where he can often be found. We went to ask him if we could have a session with him the next day, for it has been some years since we last recorded him.

Ibrahim bhai is a treasure of The Travelling Archive. He has enriched the space of our archive in non-replicable ways. Which is why when we see him in fear, looking hither and thither in the darkness with his blind eyes before whispering a promise to come to us the following day, as if we were hatching a plot; when he tells us in gestures about the silencing of the song; we feel ashamed for having taken part—directly or indirectly—in the process of this silencing.

We are a hapless people, who do not know what past to keep for the future. Ibrahim bhai had wanted us to shut the windows of the room where we were recording him on this winter morning in 2013. I still have my songs, he seemed to be saying, but I dare not sing them everywhere.

As we listen to him, over and over, in the recordings Tareque made for Matir Moyna, in our recordings of 2004, 2006, 2009 and now in 2013, we need to ask ourselves this singular and simple question: Why did Ibrahim bhai ask us to shut the windows that day, while he was singing?

And now for Sukanta, the keener listener’s story.

tta
Recording Ibrahim Boyati

ইব্রাহিম বয়াতিকে যখন ২০০৬ সালে ফরিদপুর শহরের কাছে উত্তর শোভারামপুরে সাদেক আলির খামার বাড়িতে রেকর্ড করি, ওঁর গলা শুনে তো আমার পড়ে যাবার অবস্থা!
তারেক মাসুদের মাটির ময়না ছবিতে আগে শুনেছিলাম ইব্রাহিম ভাইকে। কিন্তু সামনে থেকে ওই ঈষৎ কর্কশ অথচ মধুর গলা, কখনো একটু কম-লাগা সুর আর অতুলনীয় দোতারা বাদন শুনে ব্লুজ গায়কীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
অতিথিপরায়ণ সাদেক আলির সৌজন্যে শীতের সকাল সকাল সকলের খেজুর রসের পায়েস জুটেছিল। সেই খেয়ে দিনভর গান হল খুব। সেই আসরে ইব্রাহিম ছাড়াও আরো দু’একজন গায়ক ছিলেন, সাদেক আলি নিজে ছিলেন, তবু সবার মধ্যে কাঁচা-পাকা গোঁফ দাড়ি আর খোঁপা করা চুলের ইব্রাহিম ছিলেন নিজ বৈশিষ্ট্যে অনন্য।
পরে আর একবার ২০০৯ -এর মার্চ নাগাদ ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা হল। এবারে ওঁর বাড়িতে। ফরিদপুর শহর থেকে বেশ দূরের গ্রামে, আমরা খুঁজে খুঁজে পৌঁছলাম ওঁর বাড়ি। আগের রাতে কোথাও ম্যহফিল ছিল, বেশ ক্লান্ত ছিলেন। গান হল না, তবে কথা হল অনেকক্ষণ। ছোটবেলায় “ক্যানভাচার” ছিলেন, গান গেয়ে লোক জড়ো করে ওষুধ বিক্রি করতেন। একাত্তরের যুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার রোমহর্ষক গল্প আছে ইব্রাহিম ভাইএর। এবারে গোঁফ-দাড়ি আরও সাদা হয়েছে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে টাকা জোগাড় করে ছেলে গেছে মিডল ইস্টে কাজ করতে। ছেলের নিজের হাতে সাজানো চাঁদোয়া টাঙানো ঘর, রাংতা আর রঙীন কাগজের সজ্জা, খালি পড়ে আছে। ইব্রাহিমের পকেটে মোবাইল। ছেলের ফোন আসে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কোলে গোলগাল বাচ্চা নিয়ে সে বাপের বাড়ি এসেছে।

ইব্রাহিম খোকা পীরের শিষ্য। ফরিদপুর শহর থেকে যে রাস্তা অম্বিকাপুরের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার বাঁয়ে, কুমার নদীর ধারে খোকা পীরের আস্তানা। পীর দেহ রেখেছেন অনেকদিন। তবুও ওই মাজারটির সঙ্গে ইব্রাহিমের ওতপ্রোত সম্পর্ক। নিজের বাড়ি ছাড়া বয়াতির ওই আর একটি স্থায়ী ঠিকানা।

আমরা একথা জানতাম বলেই, ২০১২-র এক শীতের সন্ধ্যায় ইব্রাহিমের হদিশ পেতে আধো অন্ধকার মাজারে হাজির হলাম। অনেকদিন ইব্রাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ফরিদপুর যাওয়া হয় প্রায় প্রত্যেক বছর, কখনো তো বছরে দু’বারও। কিন্তু ইব্রাহিমের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়ে ওঠে না। যতবার সেই ২০০৬-এর রেকর্ডিং শুনি, মনে হয় এই মানুষটিকে জমিয়ে রেকর্ড করা দরকার।


Ibrahim Boyati in Tareque Masud’s film, Matir Moyna.

শীত সন্ধ্যায় আশপাশ নিঝুম। মাজার চত্বরে ঢুকে দেখি বেশ বড় উঠোন। একপাশে পীরের সমাধি ঘিরে বেশ বড় আটচালা, কংক্রীটে ঢালাই করা মেঝেতে বিছানো কার্পেট। আর একদিকে বসতবাড়ি। পীরের পরিবারের লোকজন থাকেন বোঝা যায়। আমাদের হঠাৎ আগমনে অবশ্য বিশেষ কেউ বেরিয়ে আসেন না। আমাদের একমাত্র বল-ভরসা সালামত ভাই অন্ধকার উঠোনে ঢুকে কাকে যেন শুধোন ইব্রাহিমের কথা। আমি ভিতরে গিয়ে দেখি, অল্পবয়সি এক পুরুষ বসে আছেন মাজারের কাছে। তাঁকে ঘিরে জনা সাত-আটেকের একটা দল। সকলেই প্রার্থনারত। অল্পবয়সি পুরুষটিই যে জমায়েতের প্রধান বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রার্থনা শেষে সকলেই তাঁর পা ধরে কদমবুসি করে উঠে পড়েন। ইব্রাহিমকে দেখি সেই দলে। কেউ গিয়ে তাঁকে বলে আমাদের কথা। ইব্রাহিম বেরিয়ে আসেন উঠোনে। প্রধান পুরুষটি নীরবে আমাদের পাশ কাটিয়ে ওপাশের বাড়িতে ঢুকে যান। অন্ধকারে আমরা কেউ কাউকে ঠিকমত দেখতে পাই না। ইব্রাহিম মৌসুমীকে চিনতে পারেন; আমাকে পারেন না। আমাদের উদ্দেশ্য শুনে একটু নীরব থাকেন। একবার বলেন গান-বাজনা বিশেষ করেন না, আবার বলেন পরের দিন অন্য কাজ আছে। আমরা অন্ধকারে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। এই ইব্রাহিমকে ঠিক চিনতে পারি না। মনটা খারাপ লাগতে থাকে। এতদূর থেকে এসেছি, এতদিনের পরিচয়, তবু এড়িয়ে যেতে চাওয়ার কি কারণ ঠিক বুঝি না। অবশেষে সকলের চাপাচাপিতে পরেরদিন ফরিদপুরে আসতে রাজি হন, আমরা যে বাড়িতে ছিলাম সেই বাড়িতে। ঠিক হয় হাবিব গিয়ে ওঁকে নিয়ে আসবে শহরে।

পরদিন সকালে আমরা অপেক্ষা করি। হাবিবের যা পাগলাটে স্বভাব, আদৌ আনতে গেল কিনা কে জানে! হাবিব অবশ্য আমাদের ডোবায় না। একসময় তার হাত ধরে ইব্রাহিম এসে ঢোকেন। সকালের উজ্জ্বল আলোয় দেখি বয়াতির মুখে একটু বয়সের ছাপ পড়েছে। দাড়ি পুরো সাদা, গোঁফ জোড়া নেই। মুখের ভাবে মনের ভাব ঠিক বোঝা যায় না।

যে বাড়িতে ছিলাম, তার লাগোয়া বিরাট বাগান। ছায়া-ছায়া নিরিবিলি বাগানে আগের দিনই লায়লার গান রেকর্ড করেছি। শীতের রোদ-ছায়া গায়ে মেখে বসতেও আরাম আর কংক্রীটের ফাঁকা ফাঁকা দেয়াল-ওয়ালা এই ঘরে টেকনিক্যাল কারণেও রেকর্ড করতে মন চায় না। কিন্তু বয়াতিকে বাইরে বসার প্রস্তাব দিতেই নাকচ করে দিলেন। অগত্যা ঘরেই আসর বসল।

মনে আছে ২০০৬-এর রেকর্ডিং সেশনে প্রথমেই গেয়েছিলেন, “এলাহি আলআমিন আল্লা বাদশা আলমপানা তুমি”। আমরা ওঁর গলায় বিচ্ছেদ গানের জন্য উশখুশ করে উঠেছিলাম। বলেছিলেন, হবে কিন্তু সবার আগে তাঁর বন্দনা করা চাই।

এবারে শুরু করলেন মাঝভান্ডার শরিফের এক গোঁসাই, রমেশের গান দিয়ে; “আমার প্রেম জ্বালায় অঙ্গ জ্বলে, জ্বালা কি দিয়ে জুড়াই”। প্রথমে একটু আড়ষ্টই ছিল কন্ঠস্বর। ধীরে ধীরে কথাবার্তায় সহজ হল। বললেন শিল্পী হিসেবে যোগ্য সন্মান পাননি বলে মনে করেন। সেই অভিমানে বিশেষ আর যান না অনুষ্ঠানে। দু’একটা বিচ্ছেদ গেয়ে, তারপর আমাদের একটু চমকে দিয়েই গাইলেন নিজের রচনা, “আমার আঙ্গিনার পাশে/ কে বাঁশি বাজায় রে/ বন্ধু, তিলেক দাঁড়ায়ে যাও, শুনি।/ তোমার লাগিয়া বন্ধু/ আমি জাগি সারারাতি রে/ জ্বালাই মোমের বাতি/ পথের দিকে চাইয়া থাকি/ আমার বন্ধু আসে নাকি”।

আমাদের মনটা ভরে গেল। ইব্রাহিম বয়াতি জাত শিল্পী। তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা তিনি পেয়েছেন কি পাননি সে বিতর্কে না গিয়েও বোঝা যায়, তাঁর অন্তরাত্মাকে কোন কিছুই দমিয়ে রাখতে পারবে না। সঙ্গীতের ফল্গুধারা সেখানে বহমান।

ভান্ডার শরিফের গোঁসাই রমেশের গল্প (ইব্রাহিম ভাইএর ভাষায় যিনি “অনেকদূর অগ্রসর হয়েছিলেন”), ওঁর মুখেই শুনেছি। রমেশ নাকি গুরুর সামনে নির্ভয় চিত্তে জেনেশুনে বিষ মেশানো সরবত পান করে গুরুর কৃপা লাভ করেছিলেন।

ইব্রাহিম বয়াতির মত শিল্পী চারদিকে দলে দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকমটা ভাবার তো কোন কারণ নেই! তিনি স্বাধীনভাবে গান করুন। গুরু-কৃপায় সব গরল নিঃশেষে হজম করে ফেলে সুরে আমাদের মাতিয়ে দিন। ভক্তিহীনের এই প্রার্থনা।

Written in 2014.